2:20 am, Wednesday, 29 October 2025

বিখ্যাত সম্রাট ও কবি বাহাদুর শাহ জাফর মৃত্যুর পূর্বেও নির্বাসিত জীবনযাপন 

বিখ্যাত সম্রাট ও কবি বাহাদুর শাহ জাফর মৃত্যুর পূর্বেও নির্বাসিত জীবনযাপন

 

নিজস্ব সংবাদদাতা দেওয়ান মনিজা বেগম

 

মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে জন্মভূমি দিল্লি থেকে বহুদূরে রেঙ্গুনে নির্বাসিত অবস্থায় ভারতবর্ষের সর্বশেষ সম্রাট ও কবি বাহাদুর শাহ জাফর চির আক্ষেপ নিয়ে লিখেছিলেন,
“কিৎনা বদনসিব হ্যাঁয় জাফর…দাফনকে লিয়ে দোগজ জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে।”
.
“কী দুর্ভাগ্য জাফরের, যে জমিন সে ভালোবাসত
সেই জমিনে তাঁর সমাধির জন্য
দুই গজ জায়গাও হলো না।”
.
যে ভারতের স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না যিনি, সেই সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনের শেষ ঠিকানা হয়নি ভারতের মাটিতে। রেঙ্গুনে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় মৃত্যু হলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো রেঙ্গুনেই।
.
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়ে ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠান। ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাহাদুর শাহ জাফর।
.
সিপাহি বিদ্রোহ যখন শুরু হয় তখন বাহাদুর শাহ দিল্লির একটি বাড়িতে ছিলেন। মিরাট থেকে ৩০০ জনের একটি বিদ্রোহী দল এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে, যার মধ্যে ছিলো সিপাহি ও অন্যান্য পেশার মানুষজন। তাঁরা বাহাদুর শাহ জাফরকে এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে বললে তিনি রাজি হন। এরপর বাহাদুর শাহ হয়ে ওঠেন ভারতের কোটি কোটি মানুষের বিদ্রোহ ও ঐক্যের প্রতীক।
.
১৮৫৭ সালের জানুয়ারিতে মিরাট ও ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
.
সে বছরের ৯ মে উত্তর প্রদেশের মিরাটের সিপাহী বিদ্রোহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল্লির পথে অগ্রসর হয়। ১১ মে সিপাহীরা দিল্লি দখল করে
ইংরেজদের বিতাড়িত করে। এ দিন দিল্লির লালকেল্লায় প্রবেশ করে বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট ঘোষণা করেন। সিপাহিরা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নিয়েছিলেন। ঐ দিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরকে দেওয়ান-ই খানোস এ সম্মাননা দেয়া হয়।
.
তাঁর একটু কথা শোনার জন্য, তাঁর গলায় একটুখানি কবিতা শোনার লক্ষ্যে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত প্রান্তর থেকেও লাখ লাখ ভারতবাসী নেহাতই পাগল হয়ে উঠেছিলো। তিনি ছিলেন ভারতের মানুষের কাছে মুক্তির মহান দূত।
বাহাদুর শাহ জাফর ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন­ এ খবর কানপুর, লক্ষেîৗ, বিহার, ঝাঁশি, বেরিলি থেকে শুরু করে পশ্চিম ও পূর্ববাংলার সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছিলো। লাখো সিপাহীর কণ্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হতো ‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহি।’ অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়া, বাদশার রাজ্য, সিপাহির হুকুম।
.
কিন্তু চার মাসের মাথায় ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করে এবং তারা কবি ও যুবরাজ মোল্লা ও কামাক্ষা, সুফি ও পণ্ডিত—সবাইকে পাকড়াও করে ফাঁসি দিতে শুরু করে। ধ্বংস করে প্রাসাদ, অগণিত মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ, বাগান ও ঘরবাড়ি।
.
২১ সেপ্টেম্বর বাহাদুর শাহ ধরা পড়ার পরদিন মেজর উইলিয়াম হাডসন তাঁর দুই পুত্র মির্জা মোগল ও মির্জা খিলজি সুলতানকে গুলি করে হত্যা করে। অবশ্য কয়েক মাস পর হ্যাডসন লক্ষ্ণৌতে কুর্দি বেগমের হাতে নিহত হয়েছিলো। ইংরেজরা তখন ২৯ জন মুঘল শাহজাদাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো।
.
১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি দিল্লিতে বাহাদুর শাহের বিচার শুরু হয় এবং সে বিচার শেষ হয় ৯ মার্চ। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন, দিল্লির সাবেক সম্রাট ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী।

প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার কথা হয়েছিলো, শেষমেশ
ইংরেজ বিচারপতি তাঁকে মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করেছিল। কারণ এতে বাহাদুর শাহ জাফর তিলে তিলে নির্মম যন্ত্রণার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করবেন এমনটাই ঠিক করেছিলো ইংরেজরা।

১৮৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ৮৩ বছরের বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর,
স্ত্রী জিনাত মহল, দুই পুত্র জওয়ান বখত ও আব্বাস বখত, পুত্রবধূ রওনক জাহান ও এক নাতনিক্যা নিয়ে ইংরেজ গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনী দিল্লি ত্যাগ করে। ৯ ডিসেম্বর জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছায়।
.
ইয়াঙ্গুনের বিখ্যাত শোয়ে ডন প্যাগোডার পূর্ব পাশে ৬ জিওয়াকা সড়কের একটি বাড়িতে বাহাদুর শাহ ও তাঁর স্বজনদের রাখা হয়। মূলত এটি ছিল ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাসভবনের একটি ছোট গ্যারেজ।
ঐতিহাসিক লালকেল্লা ছেড়ে এই সামান্য স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালের কক্ষেই
তাঁদের নির্বাসনের বন্দী জীবন চলছিল।
.
কেবল তাই না সেখানেও তাঁদের তিলে তিলে শেষ করে দেয়ার চক্রান্ত চলতো। সম্রাটকে শুতে দেয়া হয়েছিলো অতি সাধারণ একটি পাটের দড়ির খাটিয়ায়। ভারতের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে রেঙ্গুনের মাটিতে সম্রাটের জীবনের বাকি দিনগুলো চরম দু:খ ও অভাব অনটনের মধ্যে কেটেছিল। একপর্যায়ে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
.
আগেই বলেছি বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন উচ্চমার্গের কবি। শেষ ফরিয়াদ হিসেবে তিনি কেবল তাঁকে লেখার কলম, কাগজ চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটিও তাঁকে দেয়া হয়নি।
.
১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর পবিত্র শুক্রবার ভোরে ঠিক ফজরের নামাজের আগ মুহূর্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতবর্ষের সর্বশেষ সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ জাফর। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর খবরও নতুন করে বিদ্রোহের আশঙ্কায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত জানানো হয়নি। ।
.
নেলসন ডেভিস এক সপ্তাহ পর ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বাহাদুর শাহ জাফরের মৃত্যুর খবর জানান। দিল্লিতে তাঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয় ১৫ দিন পর। জীবনের শেষ বেলায় তাঁর তদারকির দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ডারিস লিখেছেন: আবু জাফর শুক্রবার ভোর পাঁচটায় মারা গেছেন।
.
ওই দিন বিকেল পাঁচটায় তাঁর দাফন সম্পন্ন করা হয় ইসলামি রীতি অনুযায়ী। একজন মাওলানা তাঁর জানাজা পড়ান। পাঞ্জাব হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি জিডি গোমেজ তাঁর বই দ্য লাস্ট মোগল-এ লিখেছেন, তাঁর কবরের চারপাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয় এবং ওপরে ঘাসের আচ্ছাদন।
.
শেষপর্যন্ত ১৮৬৭ সালে বাহাদুর শাহ জাফরের পরিবারের সদস্যদের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
.
সম্রাটের প্রিয়তমা স্ত্রী জিনাত মহল মারা যান ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুলাই। দীর্ঘ কারাবাসে জওয়ান বখতের স্ত্রী জামানি বেগম গুরুতর অসুস্থ এবং পরে অন্ধ হয়ে যান। শাহজাদা আব্বাস ইয়াঙ্গুনের এক মুসলিম ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করেন। তাঁদের বংশধরদের কেউ কেউ এখনো ইয়াঙ্গুনে বসবাস করছেন।
.
ভারতীয়রা দীর্ঘদিন বাহাদুর শাহের সমাধি সম্পর্কে কিছু জানতেন না। ১৯০৩ সালে ভারতের একটি প্রতিনিধিদল প্রথম বাহাদুর শাহর সমাধি পরিদর্শন করেন। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অযত্নের কারণে সেই সমাধিটি তখন আর চেনা যাচ্ছিল না। ১৯০৫ সালে ইয়াঙ্গুনের মুসলমানরা বাহাদুর শাহের সমাধি চিহ্নিত করার দাবি জানান।
.
১৯০৭ সালে ব্রিটিশ সরকার সমাধির ওপর পাথরখচিত ফলক বসায়, যাতে লেখা ছিল: বাহাদুর শাহ, দিল্লির সাবেক রাজা ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর এর কাছেই মারা গেছেন। ইয়াঙ্গুনের স্থানীয় মুসলমানরা তখন থেকে আজো বাহাদুর শাহকে ক্ষমতাবান সুফি বাদশাহ হিসেবে সম্মান করেন এবং এখনো দরগায় দোয়ার উদ্দেশ্যে আসেন।
.
বাহাদুর শাহ ছিলেন ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রত্যাবর্তক।
বাহাদুর শাহ জাফর যখন সিংহাসনে আরোহন করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৬২ বছর। ১৮৩৭ সালে তাঁর পিতা দ্বিতীয় আকবরের মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন তিনি। তখন মুঘল সাম্রাজ্যের শোচনীয় অবস্থা।
.
তাঁর পিতামহ আলী গওহরের সময় থেকেই মুঘল সম্রাটরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী হয়ে পড়েছিলেন। মুঘল কর্তৃত্ব তখন লাল কেল্লার চার দেয়ালে বন্দী ছিল। প্রচণ্ড প্রতাপশালী মুঘল সাম্রাজ্য তখন ইংরেজদের পদানত। ইংরেজরা ধীরে ধীরে তাদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করেই চলছিল।
.
মুদ্রা থেকে সম্রাটের নাম বাদ দেওয়া, দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে করায়ত্ত করা সহ ধীরে ধীরে মুঘলদের নাম সমূলে উৎখাতে সচেষ্ট হলেও সম্রাট হওয়ার পর বাহাদুর শাহ জাফর জানতেন তাঁর সীমাবদ্ধতা। কিন্তু কিছুই করতে না পারার হতাশা আর হাহাকার ভুলে থাকতে কাব্যচর্চায় সময় কাটাতেন তিনি। বাহাদুর শাহ জাফরের লেখা অনেক কবিতা তখনই ভারতবর্ষের সর্বত্র মানুষের মুকে উচ্চারিত হতো।
.
ইয়াঙ্গুনের আলো ঝলমল বিশালকায় ইমারতগুলোর মধ্যে বাহাদুর শাহ জাফরের প্রায় জীর্ণ দোতলা সমাধিটি আজো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। সমাধি অঙ্গনে ঢুকতেই বাঁ দিকে বাহাদুর শাহের কয়েকটি আঁকা ছবি ও ফলক আজো চোখে পড়ে।‌
.
বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি ও মাজারটি আজো পরিচালিত হয় স্বেচ্ছাদানে; মিয়ানমার সরকার থেকে কোষো অর্থ নেওয়া হয় না। মিয়ানমারের মুসলমানরা তাঁকে শুধু শেষ মোগল সম্রাট হিসেবে দেখে না; দেখেন একজন সুফি ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে। অনেকে তাঁর দরগাহে মানতও করেন।
.
বাহাদুর শাহ জাফরের বর্তমান সমাধি ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৯৯১ সালে, ভারত সরকারের সহায়তায়। এর দেয়ালে লেখা আছে ‘এই হলটি সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গিত’।
.
অবিভক্ত ভারতের মানুষের কাছে বাহাদুর শাহের সমাধি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪১ সালে বাহাদুর শাহের সমাধিতে ফুল দিয়েই ‘দিল্লি চলো’ প্রচারণা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ মিয়ানমার পার হয়ে পূর্ব ভারতের ইম্ফল পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল।
.
১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী তাঁর সমাধি সৌধ পরিদর্শন করেন ।সে সময় তিনি পরিদর্শক বইতে লিখেছিলেন
“দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে , পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে”।
.
যা বাংলায় অনুবাদ করলে দাড়ায়;
“হিন্দুস্তানে তুমি দু গজ মাটি পাও নি সত্য।তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।”
.
বাহাদুর শাহ জাফরের আজ ২৫০তম জন্মদিন‌। জন্মদিনে শেষ মোঘল সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ জাফরের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
.
এই ছবিটি বাহাদুর শাহ জাফরের সর্বশেষ ছবি। ছবিটি ১৮৫৮ সালের মে মাসে তোলা। তখন বন্দী অবস্থায় ব্রিটিশদের বিচারের রায়ের অপেক্ষায় ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর।
.
সিপাহী বিদ্রোহের পর দিল্লী থেকে বন্দি বাহাদুর শাহ জাফরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঠিক তখন বাহাদুর শাহ জাফর লিখেছিলেন অমর এই কবিতা। কৌশিক মজুমদার সে কবিতার অনুবাদ করেছিলেন এমনটাই
.
” রেশমখানি অঙ্গে ধরে তব
ধাঁধিয়েছিলে আমার দুটি চোখ,
আধফোটা ফুল হৃদয়কমলতলে
এই ঋতুরাজ তোমার সঙ্গী হোক।
.
প্রাণের সাথে চলে প্রাণের খেলা
তেমনি ছিলে ঘ্রাণের মত মোর
সময় হলে সবার যেতে হয়-
তুমিও গেলে ভেঙে সুখের দোর।
.
অধর ছুঁয়ে অধর কথা বলে
হৃদয় জানে ব্যথার গোপন সুর
পাছে তোমার ভালবাসায় পড়ি
তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি বহু দূর
.
আশার আলো নিভছে চিরতরে
মনকে আমি বোঝাই নাকো আর
ধুলোয় ছিলাম, ধুলোয় ফিরে যাব
আমায় আজ কারই বা দরকার?
.
দিল্লী তুমি আমার দেবপুরী
আদর যেন বইত হাওয়ার ভেলা
এখন তুমি জ্বলতে থাকা চিতা
জমতে থাকা কান্না, অবহেলা।
.
রাস্তা জুড়ে শবের স্তুপ জমে
চোখের জল শুকিয়ে গেছে যেন
মৃতেরা সব নেই তো কোনখানে
দিল্লী, তুমি এমন হলে কেন?
.
ছিন্ন হৃদয়, ছিন্ন মাংস-হাড়
মনন জ্বলে দীর্ঘ সব শ্বাসে
রক্তপুরী, সব হারাদের দেশ
আমার চোখ সজল হয়ে আসে।
.
চিরটাকাল সঙ্গে কে আর থাকে?
সবার ভাগ্যে সব ভাল কি সয়?
মনে ভাবি পরম নবীর বাণী
সকল কিছু ভালোর জন্য হয়।”

সৌজন্যে: আহমাদ ইশতিয়াক

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Popular Post

কেন্দ্রীয় কমিটির সহ- সাধারণ সম্পাদক, মাদারীপুর-২ আসনে,মনোনয়ন প্রত্যাশী,হিমেল আল ইমরান গনসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ

বিখ্যাত সম্রাট ও কবি বাহাদুর শাহ জাফর মৃত্যুর পূর্বেও নির্বাসিত জীবনযাপন 

Update Time : 01:43:51 pm, Tuesday, 28 October 2025

বিখ্যাত সম্রাট ও কবি বাহাদুর শাহ জাফর মৃত্যুর পূর্বেও নির্বাসিত জীবনযাপন

 

নিজস্ব সংবাদদাতা দেওয়ান মনিজা বেগম

 

মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে জন্মভূমি দিল্লি থেকে বহুদূরে রেঙ্গুনে নির্বাসিত অবস্থায় ভারতবর্ষের সর্বশেষ সম্রাট ও কবি বাহাদুর শাহ জাফর চির আক্ষেপ নিয়ে লিখেছিলেন,
“কিৎনা বদনসিব হ্যাঁয় জাফর…দাফনকে লিয়ে দোগজ জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে।”
.
“কী দুর্ভাগ্য জাফরের, যে জমিন সে ভালোবাসত
সেই জমিনে তাঁর সমাধির জন্য
দুই গজ জায়গাও হলো না।”
.
যে ভারতের স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না যিনি, সেই সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের জীবনের শেষ ঠিকানা হয়নি ভারতের মাটিতে। রেঙ্গুনে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় মৃত্যু হলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো রেঙ্গুনেই।
.
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়ে ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠান। ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাহাদুর শাহ জাফর।
.
সিপাহি বিদ্রোহ যখন শুরু হয় তখন বাহাদুর শাহ দিল্লির একটি বাড়িতে ছিলেন। মিরাট থেকে ৩০০ জনের একটি বিদ্রোহী দল এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে, যার মধ্যে ছিলো সিপাহি ও অন্যান্য পেশার মানুষজন। তাঁরা বাহাদুর শাহ জাফরকে এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে বললে তিনি রাজি হন। এরপর বাহাদুর শাহ হয়ে ওঠেন ভারতের কোটি কোটি মানুষের বিদ্রোহ ও ঐক্যের প্রতীক।
.
১৮৫৭ সালের জানুয়ারিতে মিরাট ও ব্যারাকপুরে শুরু হওয়া বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
.
সে বছরের ৯ মে উত্তর প্রদেশের মিরাটের সিপাহী বিদ্রোহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল্লির পথে অগ্রসর হয়। ১১ মে সিপাহীরা দিল্লি দখল করে
ইংরেজদের বিতাড়িত করে। এ দিন দিল্লির লালকেল্লায় প্রবেশ করে বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট ঘোষণা করেন। সিপাহিরা সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নিয়েছিলেন। ঐ দিন গভীর রাতে লালকেল্লায় একুশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে ৮২ বছরের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফরকে দেওয়ান-ই খানোস এ সম্মাননা দেয়া হয়।
.
তাঁর একটু কথা শোনার জন্য, তাঁর গলায় একটুখানি কবিতা শোনার লক্ষ্যে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত প্রান্তর থেকেও লাখ লাখ ভারতবাসী নেহাতই পাগল হয়ে উঠেছিলো। তিনি ছিলেন ভারতের মানুষের কাছে মুক্তির মহান দূত।
বাহাদুর শাহ জাফর ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন­ এ খবর কানপুর, লক্ষেîৗ, বিহার, ঝাঁশি, বেরিলি থেকে শুরু করে পশ্চিম ও পূর্ববাংলার সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছিলো। লাখো সিপাহীর কণ্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হতো ‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহি।’ অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়া, বাদশার রাজ্য, সিপাহির হুকুম।
.
কিন্তু চার মাসের মাথায় ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করে এবং তারা কবি ও যুবরাজ মোল্লা ও কামাক্ষা, সুফি ও পণ্ডিত—সবাইকে পাকড়াও করে ফাঁসি দিতে শুরু করে। ধ্বংস করে প্রাসাদ, অগণিত মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ, বাগান ও ঘরবাড়ি।
.
২১ সেপ্টেম্বর বাহাদুর শাহ ধরা পড়ার পরদিন মেজর উইলিয়াম হাডসন তাঁর দুই পুত্র মির্জা মোগল ও মির্জা খিলজি সুলতানকে গুলি করে হত্যা করে। অবশ্য কয়েক মাস পর হ্যাডসন লক্ষ্ণৌতে কুর্দি বেগমের হাতে নিহত হয়েছিলো। ইংরেজরা তখন ২৯ জন মুঘল শাহজাদাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো।
.
১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি দিল্লিতে বাহাদুর শাহের বিচার শুরু হয় এবং সে বিচার শেষ হয় ৯ মার্চ। হাজির করা হয় বানোয়াট সাক্ষী। বিচারকরা রায় দেন, দিল্লির সাবেক সম্রাট ১০ মে থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনের দায়ে অপরাধী।

প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার কথা হয়েছিলো, শেষমেশ
ইংরেজ বিচারপতি তাঁকে মিয়ানমারে নির্বাসনে পাঠানোর সুপারিশ করেছিল। কারণ এতে বাহাদুর শাহ জাফর তিলে তিলে নির্মম যন্ত্রণার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করবেন এমনটাই ঠিক করেছিলো ইংরেজরা।

১৮৫৮ সালের ৭ অক্টোবর ৮৩ বছরের বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর,
স্ত্রী জিনাত মহল, দুই পুত্র জওয়ান বখত ও আব্বাস বখত, পুত্রবধূ রওনক জাহান ও এক নাতনিক্যা নিয়ে ইংরেজ গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনী দিল্লি ত্যাগ করে। ৯ ডিসেম্বর জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছায়।
.
ইয়াঙ্গুনের বিখ্যাত শোয়ে ডন প্যাগোডার পূর্ব পাশে ৬ জিওয়াকা সড়কের একটি বাড়িতে বাহাদুর শাহ ও তাঁর স্বজনদের রাখা হয়। মূলত এটি ছিল ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাসভবনের একটি ছোট গ্যারেজ।
ঐতিহাসিক লালকেল্লা ছেড়ে এই সামান্য স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালের কক্ষেই
তাঁদের নির্বাসনের বন্দী জীবন চলছিল।
.
কেবল তাই না সেখানেও তাঁদের তিলে তিলে শেষ করে দেয়ার চক্রান্ত চলতো। সম্রাটকে শুতে দেয়া হয়েছিলো অতি সাধারণ একটি পাটের দড়ির খাটিয়ায়। ভারতের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে রেঙ্গুনের মাটিতে সম্রাটের জীবনের বাকি দিনগুলো চরম দু:খ ও অভাব অনটনের মধ্যে কেটেছিল। একপর্যায়ে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
.
আগেই বলেছি বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন উচ্চমার্গের কবি। শেষ ফরিয়াদ হিসেবে তিনি কেবল তাঁকে লেখার কলম, কাগজ চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটিও তাঁকে দেয়া হয়নি।
.
১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর পবিত্র শুক্রবার ভোরে ঠিক ফজরের নামাজের আগ মুহূর্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতবর্ষের সর্বশেষ সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ জাফর। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর খবরও নতুন করে বিদ্রোহের আশঙ্কায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত জানানো হয়নি। ।
.
নেলসন ডেভিস এক সপ্তাহ পর ব্রিটিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বাহাদুর শাহ জাফরের মৃত্যুর খবর জানান। দিল্লিতে তাঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয় ১৫ দিন পর। জীবনের শেষ বেলায় তাঁর তদারকির দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ডারিস লিখেছেন: আবু জাফর শুক্রবার ভোর পাঁচটায় মারা গেছেন।
.
ওই দিন বিকেল পাঁচটায় তাঁর দাফন সম্পন্ন করা হয় ইসলামি রীতি অনুযায়ী। একজন মাওলানা তাঁর জানাজা পড়ান। পাঞ্জাব হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি জিডি গোমেজ তাঁর বই দ্য লাস্ট মোগল-এ লিখেছেন, তাঁর কবরের চারপাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয় এবং ওপরে ঘাসের আচ্ছাদন।
.
শেষপর্যন্ত ১৮৬৭ সালে বাহাদুর শাহ জাফরের পরিবারের সদস্যদের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
.
সম্রাটের প্রিয়তমা স্ত্রী জিনাত মহল মারা যান ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুলাই। দীর্ঘ কারাবাসে জওয়ান বখতের স্ত্রী জামানি বেগম গুরুতর অসুস্থ এবং পরে অন্ধ হয়ে যান। শাহজাদা আব্বাস ইয়াঙ্গুনের এক মুসলিম ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করেন। তাঁদের বংশধরদের কেউ কেউ এখনো ইয়াঙ্গুনে বসবাস করছেন।
.
ভারতীয়রা দীর্ঘদিন বাহাদুর শাহের সমাধি সম্পর্কে কিছু জানতেন না। ১৯০৩ সালে ভারতের একটি প্রতিনিধিদল প্রথম বাহাদুর শাহর সমাধি পরিদর্শন করেন। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অযত্নের কারণে সেই সমাধিটি তখন আর চেনা যাচ্ছিল না। ১৯০৫ সালে ইয়াঙ্গুনের মুসলমানরা বাহাদুর শাহের সমাধি চিহ্নিত করার দাবি জানান।
.
১৯০৭ সালে ব্রিটিশ সরকার সমাধির ওপর পাথরখচিত ফলক বসায়, যাতে লেখা ছিল: বাহাদুর শাহ, দিল্লির সাবেক রাজা ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর এর কাছেই মারা গেছেন। ইয়াঙ্গুনের স্থানীয় মুসলমানরা তখন থেকে আজো বাহাদুর শাহকে ক্ষমতাবান সুফি বাদশাহ হিসেবে সম্মান করেন এবং এখনো দরগায় দোয়ার উদ্দেশ্যে আসেন।
.
বাহাদুর শাহ ছিলেন ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রত্যাবর্তক।
বাহাদুর শাহ জাফর যখন সিংহাসনে আরোহন করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৬২ বছর। ১৮৩৭ সালে তাঁর পিতা দ্বিতীয় আকবরের মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন তিনি। তখন মুঘল সাম্রাজ্যের শোচনীয় অবস্থা।
.
তাঁর পিতামহ আলী গওহরের সময় থেকেই মুঘল সম্রাটরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী হয়ে পড়েছিলেন। মুঘল কর্তৃত্ব তখন লাল কেল্লার চার দেয়ালে বন্দী ছিল। প্রচণ্ড প্রতাপশালী মুঘল সাম্রাজ্য তখন ইংরেজদের পদানত। ইংরেজরা ধীরে ধীরে তাদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করেই চলছিল।
.
মুদ্রা থেকে সম্রাটের নাম বাদ দেওয়া, দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে করায়ত্ত করা সহ ধীরে ধীরে মুঘলদের নাম সমূলে উৎখাতে সচেষ্ট হলেও সম্রাট হওয়ার পর বাহাদুর শাহ জাফর জানতেন তাঁর সীমাবদ্ধতা। কিন্তু কিছুই করতে না পারার হতাশা আর হাহাকার ভুলে থাকতে কাব্যচর্চায় সময় কাটাতেন তিনি। বাহাদুর শাহ জাফরের লেখা অনেক কবিতা তখনই ভারতবর্ষের সর্বত্র মানুষের মুকে উচ্চারিত হতো।
.
ইয়াঙ্গুনের আলো ঝলমল বিশালকায় ইমারতগুলোর মধ্যে বাহাদুর শাহ জাফরের প্রায় জীর্ণ দোতলা সমাধিটি আজো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। সমাধি অঙ্গনে ঢুকতেই বাঁ দিকে বাহাদুর শাহের কয়েকটি আঁকা ছবি ও ফলক আজো চোখে পড়ে।‌
.
বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি ও মাজারটি আজো পরিচালিত হয় স্বেচ্ছাদানে; মিয়ানমার সরকার থেকে কোষো অর্থ নেওয়া হয় না। মিয়ানমারের মুসলমানরা তাঁকে শুধু শেষ মোগল সম্রাট হিসেবে দেখে না; দেখেন একজন সুফি ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে। অনেকে তাঁর দরগাহে মানতও করেন।
.
বাহাদুর শাহ জাফরের বর্তমান সমাধি ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৯৯১ সালে, ভারত সরকারের সহায়তায়। এর দেয়ালে লেখা আছে ‘এই হলটি সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গিত’।
.
অবিভক্ত ভারতের মানুষের কাছে বাহাদুর শাহের সমাধি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪১ সালে বাহাদুর শাহের সমাধিতে ফুল দিয়েই ‘দিল্লি চলো’ প্রচারণা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ মিয়ানমার পার হয়ে পূর্ব ভারতের ইম্ফল পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল।
.
১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী তাঁর সমাধি সৌধ পরিদর্শন করেন ।সে সময় তিনি পরিদর্শক বইতে লিখেছিলেন
“দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে , পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে”।
.
যা বাংলায় অনুবাদ করলে দাড়ায়;
“হিন্দুস্তানে তুমি দু গজ মাটি পাও নি সত্য।তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।”
.
বাহাদুর শাহ জাফরের আজ ২৫০তম জন্মদিন‌। জন্মদিনে শেষ মোঘল সম্রাট কবি বাহাদুর শাহ জাফরের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
.
এই ছবিটি বাহাদুর শাহ জাফরের সর্বশেষ ছবি। ছবিটি ১৮৫৮ সালের মে মাসে তোলা। তখন বন্দী অবস্থায় ব্রিটিশদের বিচারের রায়ের অপেক্ষায় ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর।
.
সিপাহী বিদ্রোহের পর দিল্লী থেকে বন্দি বাহাদুর শাহ জাফরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঠিক তখন বাহাদুর শাহ জাফর লিখেছিলেন অমর এই কবিতা। কৌশিক মজুমদার সে কবিতার অনুবাদ করেছিলেন এমনটাই
.
” রেশমখানি অঙ্গে ধরে তব
ধাঁধিয়েছিলে আমার দুটি চোখ,
আধফোটা ফুল হৃদয়কমলতলে
এই ঋতুরাজ তোমার সঙ্গী হোক।
.
প্রাণের সাথে চলে প্রাণের খেলা
তেমনি ছিলে ঘ্রাণের মত মোর
সময় হলে সবার যেতে হয়-
তুমিও গেলে ভেঙে সুখের দোর।
.
অধর ছুঁয়ে অধর কথা বলে
হৃদয় জানে ব্যথার গোপন সুর
পাছে তোমার ভালবাসায় পড়ি
তোমায় ছেড়ে যাচ্ছি বহু দূর
.
আশার আলো নিভছে চিরতরে
মনকে আমি বোঝাই নাকো আর
ধুলোয় ছিলাম, ধুলোয় ফিরে যাব
আমায় আজ কারই বা দরকার?
.
দিল্লী তুমি আমার দেবপুরী
আদর যেন বইত হাওয়ার ভেলা
এখন তুমি জ্বলতে থাকা চিতা
জমতে থাকা কান্না, অবহেলা।
.
রাস্তা জুড়ে শবের স্তুপ জমে
চোখের জল শুকিয়ে গেছে যেন
মৃতেরা সব নেই তো কোনখানে
দিল্লী, তুমি এমন হলে কেন?
.
ছিন্ন হৃদয়, ছিন্ন মাংস-হাড়
মনন জ্বলে দীর্ঘ সব শ্বাসে
রক্তপুরী, সব হারাদের দেশ
আমার চোখ সজল হয়ে আসে।
.
চিরটাকাল সঙ্গে কে আর থাকে?
সবার ভাগ্যে সব ভাল কি সয়?
মনে ভাবি পরম নবীর বাণী
সকল কিছু ভালোর জন্য হয়।”

সৌজন্যে: আহমাদ ইশতিয়াক